মৃত্যু চিরন্তন, মৃত্যু অনিবার্য। তারপরেও মৃত্যুকে যত ভয়। ছোটোবেলা থেকেই মৃত মানুষের কাছে যেতে পারি না। পরিবারের কেউ জোরও করেনি। রাগ দেখিয়ে কোনোদিন বলেনি, ‘তোকে যেতেই হবে, কেন যাবি না? মরলে মরবি, দুইদিন আগে আর পরে’। তাদের প্রশ্রয়ে মনের ভিতর ভয়টা ক্রমশ বাসা বেঁধেছে। মৃত্যুর কথা শুনলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। ছোটোবেলা থেকে মা আমাকে কারো মৃত্যু সংবাদ দিত না। সবাইকে নিষেধ করেছে, ‘আমার সামনে সেরকম কোনো খবর কেউ উচ্চারণ করবে না’।
অসুস্থ মানুষ দেখলে আমিও অসুস্থ বোধ করি। রোগটা সারানোর কেউ চেষ্টাও করল না। বরং মেনে নিল, আমার জন্যে এটাই যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আমি ঢাকা থেকে ছুটে গিয়ে মায়ের কেবিনে শুয়ে থাকলাম। সবাই খুব অবাক! অনেকেই ভাবল আমি হয়তো সুস্থ হয়ে গেছি, ভয় কেটে গেছে। কিন্তু এটা তো ব্যতিক্রমী ঘটনা, মায়ের জন্যে আমি সব পারি। মনের ভয় অনেক কষ্টে লুকিয়ে রেখেছি, বুঝতে দেইনি।
থেকে থেকে মা বলে, ‘তুই এইঠে ক্যানে, বাড়িত যা’! তবুও যাই না। শুয়ে শুয়ে মায়ের হাসিমুখ দেখি। ভালো করেই জানি, আমি চলে গেলে সেই চিন্তায় তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর মা যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন, আমিও নিশ্চিন্তে ঢাকায় ফিরলাম। কিছুদিন পর তিনি আবার শয্যাশায়ী। বার্ধক্যজনিত কারণে ডাক্তার এবার মাকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা করাতে বললেন। দীর্ঘদিন বিছানায় কষ্ট পেয়ে তিনি চলে গেলেন। সবাই ভাবল যাক যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। তার মৃত্যুটা আমিই কেবল মেনে নিতে পারলাম না। ভাবি এর চেয়ে খারাপ কিছু আর কি হতে পারে?
যাত্রাপথের দীর্ঘ রাত… কিছুতেই ঘুম এলো না। মায়ের বিভিন্ন স্মৃতি শুধুই চোখে ভাসে… বাড়ি পৌঁছে দেখি, মশারির ভিতর মা শুয়ে আছেন। তীব্র ঠান্ডায় তার পুরো শরীর বরফে ঢাকা। কাছে যেতেই ছোটো মামি বললেন, ‘বাবা আসো, ভয় পেও না’। দেখি মা শান্তির ঘুম ঘুমায়। মনে হলো একটু পরেই তিনি জেগে উঠবেন, নিশ্চুপ বসে আবার তসবি পড়তে পড়তে পান খাবেন। আমি কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরব, মুখে মুখ লাগিয়ে বলব, ‘পান দে’। সবচেয়ে অবাক হলাম, যখন দেখলাম, আমার কিছুতেই কান্না পেল না! ভাবলাম, আমি পাষাণ পুরুষ, একটা পাষণ্ড!
মাকে মাটির বিছানায় রেখে এলাম। তবুও এক ফোঁটা চোখের জল কেউ দেখল না। আঁধার হলে-একলা ঘরে বুক ফেটে কেবল কান্না আসে, কেউ তা কোনোদিন জানল না! জানবেও না…
আপনার মতামত জানান